প্রকাশিত: / বার পড়া হয়েছে
ইউরোপের বৃদ্ধজীবনের করুণ একাকিত্ব আর বাংলাদেশের পারিবারিক বন্ধনের উষ্ণতা আমাকে মানব অস্তিত্বের মৌলিক প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়েছে। এ শুধু দুই সংস্কৃতির বৈপরীত্য নয়; এ হল আধুনিকতার নামে মানবিকতার ওপর চলা এক নিগ্রহের মর্মস্পর্শী দলিল।
ইউরোপের প্রতিযোগিতামূলক অর্থনীতি ও যান্ত্রিক সভ্যতা মানুষকে পরিণত করেছে "ইকোনমিক ইউনিট"-এ। বার্ধক্য এখানে উৎপাদনশীলতার বিপরীত ধারণা—একটি "লাইফবিম" যার মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে। বৃদ্ধরা সমাজের সেই "শেলফ এক্সপায়ার্ড প্রোডাক্ট" যাদের ঠাঁই হয় নার্সিং হোমে অথবা নির্জন গৃহে।
ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের নামে গড়ে ওঠা অদৃশ্য প্রাচীর এতটাই নির্মম যে, পাশের ফ্ল্যাটের বৃদ্ধার মৃতু হলেও জানার উপায় নেই। ভিডিও কল, হেলথ মনিটর—এগুলো সম্পর্কের ভেলকিবাজি মাত্র। নাতির স্ক্রিনে দেখা মুখ কি কখনও দাদুর কাঁপা হাতের স্পর্শ দিতে পারে? এ হল "মানুষ্য হীনতার ডিজিটালাইজেশন।"
এর বিপরীতে বাংলাদেশের দারিদ্র্যপীড়িত সমাজে লুকিয়ে আছে এক আত্মিক বিপ্লব। যেখানে ইউরোপের অর্থনীতি GDP-তে মাপা হয়, সেখানে বাংলাদেশের গ্রামের সম্পদ মাপা হয় মা-বাবার ছানি পড়া চোখের তৃপ্তিতে। —এগুলোই এখানে সম্পদের প্রকৃত মুদ্রা।
আমাদের বাংলাদেশে একজন বৃদ্ধের মৃত্যুশয্যায় গোটা পাড়ার উপস্থিতি প্রমাণ করে - এখানে মৃত্যুও একা হয় না। শেষযাত্রায় শোকগাথা গাওয়ার জন্য পেশাদার শোকাহতের প্রয়োজন পড়ে না।
আমি মনে করি বৃদ্ধ পিতা মাতারা " আমাদের পরিবারের ছায়া"—এই স্বীকারোক্তিতে লুকিয়ে আছে এক
গভীর দার্শনিক সত্য: "মানুষ তখনই পূর্ণ হয় যখন সে অন্যদের অস্তিত্বের অংশ হয়ে ওঠে"।
এই দুই বিশ্বের মৌলিক দ্বন্দ্ব চিরন্তন:
- ইউরোপ "যুক্তিকে প্রাধান্য দেয়",
বাংলাদেশ "অনুভূতিকে"
- ইউরোপ ব্যক্তির "অধিকার "চায়, বাংলাদেশ সমষ্টির "দায়িত্ব"
- ইউরোপের কাছে "সময় = অর্থ",
বাংলাদেশের কাছে "সময় = সম্পর্ক"
- সেখানে বার্ধক্য "বোঝা",
এখানে বার্ধক্য "ভাণ্ডার"।
কঠোর সত্য হল: ইউরোপের ফ্ল্যাটে সেন্ট্রাল হিটিং আছে, কিন্তু হৃদয় জমে বরফ। বাংলাদেশের টিনের ঘরে ফাটল দিয়ে ঠান্ডা বাতাস ঢোকে, কিন্তু মানুষের স্পর্শের উষ্ণতা তাকে হার মানায়।
টাকার বিনিময়ে কি কেনা যায় নাতপুতির ঘামে ভেজা কপালে চুম্বনের অনুভূতি?
প্রযুক্তি কি তৈরি করতে পারে মায়ের কাশি শুনে ছুটে আসা সন্তানের সেই জরুরি পদধ্বনি? স্বাধীনতার নামে আমরা কি নিজেদের বানাচ্ছি অভিজাত কারাগারের বাসিন্দা?
ইউরোপের বৃদ্ধারা প্রমাণ করছেন: অর্থ দিয়ে নিরাপত্তা কেনা যায়, কিন্তু সান্ত্বনা কেনা যায় না। বিপরীতে বাংলাদেশের দরিদ্র ঘরগুলো জানান দিচ্ছে: সম্পর্কের অভাব কোনো প্রযুক্তি দিয়ে পূরণ হয় না। আধুনিক সভ্যতার চরম পরিহাস এই যে, এই ইউরোপ মঙ্গলগ্রহে বসতি গড়ার পরিকল্পনা করে, কিন্তু পাশের ঘরের বৃদ্ধ দম্পতিকে একটা ওষুধের বড়ি খাওয়ানোর সময় বের করার পরিকল্পনা উপায় বের করে না।